জাতীয় চার নেতার নাম জানে না একজন শিক্ষার্থীও। জানে না মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম কী, এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষার্থীরা বলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান ও এম এ জি ওসমানীর নাম। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে বলেও ধারণা তাদের।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) মিলনায়তনে আয়োজিত ‘বিজয়ের ৫০ বছর : পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ-বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে উপস্থাপন করা গবেষণাপত্রে এসব তথ্য উঠে আসে।
গবেষণাটি ২০১৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে টঙ্গী এলাকার সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা হয়। এতে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১০৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট ২০টি প্রশ্নের মধ্যে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের জবাব দেওয়া ১৫টি প্রশ্নের ক্ষেত্রে ভুল উত্তরের হার বেশি। শিক্ষার্থীরা শহীদ বলতে শুধু সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতকেই বোঝে। প্রথম সরকার সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না।
জাতীয় চার নেতার নাম বলো, এর জবাবে শতভাগ শিক্ষার্থী ভুল উত্তর দিয়েছে। পৃথক উত্তরে তারা বলে, বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও এইচ এম এরশাদ জাতীয় চার নেতা। ৩ নভেম্বর সম্পর্কেও শতভাগ শিক্ষার্থী ভুল উত্তর দিয়েছে। ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তরে বলে, মুক্তিবাহিনী, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।
স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারের মধ্যে পার্থক্য কী—এমন প্রশ্নেও শতভাগ শিক্ষার্থী ভুল উত্তর দিয়েছে। ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তর দেয়, খন্দকার মোশতাক ছিলেন প্রথম শহীদ, সেক্টর কমান্ডার, কবি ও ভাষাসৈনিক। একজন সেক্টর কমান্ডারের নাম জানতে চাইলে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী নাম বলতে পারেনি।
গবেষণা প্রবন্ধ উত্থাপন শেষ হলে আলোচনায় অংশ নিয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ‘এই জরিপের ফল আমাকে খুবই আতঙ্কিত করেছে। হয়তো এতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। তবু বলব, একজন শিক্ষার্থীও কেন এমন জবাব দিবে। ’ তিনি বলেন, ‘এ জন্য আমি শিক্ষার্থীদের দোষ দিব না। এই দোষ আমাদের। আমরা বাচ্চাদের ঠিকমতো শেখাতে পারিনি। পড়াশোনার মধ্যে বাচ্চাদের জন্য আনন্দদায়ক কিছু যুক্ত করতে হবে। শুধু তথ্য জেনে কিছুই হবে না। ’
সেমিনারে বিলিয়ার পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ছোটবেলায় ছেলেমেয়েরা কী জ্ঞান পাচ্ছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকে পাঠ্য বইতে শিক্ষার্থীরা যা পড়ছে, সে বিশ্বাসটা তাদের মধ্যে থাকবে। তাই পাঠ্য বইতে আমরা তাদের কিভাবে সে ইতিহাস জানাচ্ছি এটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বইতে অনেক ভুল ইতিহাস রয়েছে। এটা সরাসরি সংবিধানবিরোধী। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না। পাঠ্যপুস্তকে এসব ভুল সংশোধন হওয়া উচিত। ’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, ‘বই থেকে অনেক বিখ্যাত সাহিত্য বাদ দেওয়া হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাদ যায়। ওড়না বিতর্কের কথা নিশ্চয় মনে আছে। পাঠ্য বইয়ে সাম্প্রদায়িক জিনিস ঢুকে যাচ্ছে। পুস্তক তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে ভুল আছে। আমরা আমাদের সন্তানদের ভালো-মন্দ শেখার সুযোগ দিচ্ছি না। ’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক রচনা করার মতো চর্চা আমাদের কম। আমরা বইয়ের বিভিন্ন ভুল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তার পরও কিভাবে যেন গণহত্যার সঙ্গে শামিল শব্দটা থেকে যায়। এর জন্য আমরা খুবই লজ্জিত। ’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা কিছু কনটেন্ট তৈরি করতে চাই। সেগুলো যদি শিক্ষক-ছাত্রদের কাছে পৌঁছানো যায়, তাহলে ক্লাসরুমে আনন্দের সঙ্গে পড়ানো যাবে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। দেশের পাঠ্যক্রমে আমরা অনেক কিছু যুক্ত করেছি, আরো অনেক কিছু যুক্ত করতে পারব। ’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন