এনটিআরসিএ’র নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের প্যানেল ভিত্তিক নিয়োগ এখন শেখ হাসিনা সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং সময়ের দাবি।
— আমির আসহাব
২০০৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক ভাবে গঠিত হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা ও যোগ্য শিক্ষক দ্বারা বেসরিকারি শিক্ষাক্ষেত্রকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। উল্লেখ্য এনটিআরসিএ‘র প্রতিষ্ঠাকালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল তাদের নীতিমালায়। তথ্যটি এমন যে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হতে হলে অবশ্যই এনটিআরসিএ’র প্রদত্ত সনদ থাকতে হবে এবং ইতোপূর্বে যে সকল শিক্ষক পাঠদানের অনুমতি পেয়েছে তাদেরকে প্রশিক্ষনের আওতায় এনে সমন্বয় করা হবে। ২০০৬ সালের ৩০ জুলাই গেজেট পাস করে এনটিআরসিএ’র কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। গেজেটের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরা হলো:
৩/ শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়নের জন্য পরীক্ষা গ্রহণ-
(১) শিক্ষক হিসাবে নিবন্ধন ও প্রত্যয়নের জন্য প্রার্থীর যোগ্যতা নিরুপণ ও এতদ্বিষয়ে প্রত্যয়নপত্র প্রদানের উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ প্রতি পঞ্জিকা বর্ষে অনন্ত একবার পরীক্ষা গ্রহণ করিবে।
৩ (ক) শূন্যপদের সংখ্যা নিরুপণ:
(১) কর্তৃপক্ষ প্রতি বৎসর নভেম্বর মাসের মধ্যে জেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে জেলাধীন সংশিষ্ট বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পদ ও বিষয়-ভিত্তিক শুন্য পদের তালিকা সংগ্রহ করিবে।
(২) সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার উপ-বিধি (১) এ উল্লিখিত তালিকা প্রনয়ণ করিয়া অক্টোবর মাসের মধ্যে জেলা শিক্ষা অফিসারের নিকট দাখিল করিবেন।
(৩) জেলা শিক্ষা অফিসার উক্ত তালিকার সঠিকতা যাচাইক্রমে কর্তৃপক্ষর অনুকূলে প্রেরণ করিবেন এবং কর্তৃপক্ষ উক্ত তালিকার ভিত্তিতে পরীক্ষা গ্রহণনের ব্যবস্থা করিবেন।
অন্তত একটা স্পষ্ট যে, নিবন্ধনধারী সবাই শূন্য পোস্টের বিপরীতে নির্বাচিত হয়েছে। যদিও গেজেট অনুসারে শূন্য পদের অতিরিক্ত ২০% সনদ দেওয়ার কথা ছিল। ধরে নিলাম এনটিআরসিএ এ সুযোগটা কাছে লাগিয়ে শুধু সনদ দিয়েই যাচ্ছে এবং সনদে লিখে যাচ্ছে নিয়োগযোগ্য । আরও একটু বিশ্লেষণ করলে হয়তো বিষয়টা পরিস্কার হবে। এনটিআরসিএ তখন শুধু যোগ্য প্রার্থী বাচাইয়ের মধ্যে সীমাবন্ধ ছিল। প্রকৃত পক্ষে নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল কমিটির হাতে। কমিটি নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করে নিকট আত্মীয় বা দর কষাকষির মাধ্যমে নিজের খুশির একজনকে সুযোগটি দিত। এতে নিবন্ধনধারীর নাম্বার কোনো বিষয় ছিল না, কেননা পরীক্ষা নেওয়ার নাম করে কৌশলে মনোনিত প্রার্থীকে এগিয়ে রাখত। সভাপতি, থানা শিক্ষা অফিসার এমনি প্রতিষ্ঠান প্রধান সবাই ছিল পুজি ছাড়া ব্যবসার ধান্ধায়। বিষয়টি তাহলে কি দাঁড়াল? নিয়োগ পাওয়ার জন্য সনদ শুধু একটি শর্তমাত্র, মূল যোগ্যতা ছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। কথাগুলো আমার সেখানে না, যেভাবেই হোক নিয়োগ তো হয়েছে। তাহলে প্রকৃত সনদধারীর সংখ্যা এখনও ৬ লাখ ৩৪ হাজার ১২৭ জন থাকে কিভাবে? যদি ধরে নেই কমিটির হাতে কোনো প্রকৃত সনদধরীর নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়নি, তাহলে তাদেরকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমপিও দিল কিভাবে? কিভাবে তারা এতোগুলো পথ পাড়ি দিয়ে দাম্ভিকতার সাথে আজও শিক্ষাক্ষেত্রকে কলুষিত করছে?
এবার আসি এনটিআরসিএ’র জুয়া খেলার ব্যাপারে। ২০১৬ সালে কমিটির হাত থেকে ক্ষমতা আসে এনটিআরসিএ’র হাতে। হাফ ছেড়ে বাঁচে চাকরি প্রত্যাশি নিবন্ধনধারী। কিন্তু বিধিবাম, সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে জুয়া খেলার এক রমরমা ব্যবসায় মেতে উঠে এনটিআরসিএ। দীর্ঘ ১-১৫তমদের জন্য মাত্র তিনটি গণবিজ্ঞপ্তি। অথচ গেজেটে কী ছিল? সেকথা না হয় বাদই দিলাম, প্রতি গণবিজ্ঞপ্তিতেই নিয়োগ দিচ্ছেন নির্দিষ্ট সংখ্যক নিয়োগ প্রত্যাশিদের। তবু কেন কমছে না নিবন্ধনধারীর সংখ্যা? উত্তরটা সহজ। উত্তরটা হচ্ছে- যে সব নিয়োগ প্রত্যাশি উচ্চ নম্বরধারী একবার আবেদন করে নিয়োগের সুপারিশ পাচ্ছেন। দ্বিতীয় বার আবার ঘুরে ফিরে তারাই নতুন করে সুপারিশ প্রাপ্ত হচ্ছেন। এতে নতুন সুপারিশ অনুসারে ইনডেক্সধারী ব্যক্তি যোগদান করলে তার পূর্বের শূন্য পদটি নতুন করে শূন্য হচ্ছে। আর যোগদান না করলে দখলকৃত পদটি শূন্যই থেকে যাচ্ছে। আর এভাবে সৃষ্টি হচ্ছে কৃত্রিম শিক্ষক সংকট। প্রতিবারই এনটিআরসিএ’র গ্রাহক বা জুয়ারি হচ্ছেন বঞ্চিত নিবন্ধনধরীরা। তাহলে কথা হলো ইনডেক্সধারীদের কেন গণবিজ্ঞপ্তির নামে বদলি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে? হয়তো এর জন্যও উত্তর প্রস্তুত আছে, কারণ বদলির একতিয়ার তো এনটিআরসিএ’র হাতে না। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ। সবাইকে একসাথে রেখে যদি খেলাটা ভালো জমে তাতে এনটিআরসিএ’ দোষ কোথায়? হ্যাঁ আছে- কেন এনটিআরসিএ শূন্য পদের নাম করে শুধু সনদ দিয়েই যাচ্ছে? কেন ১-১২তম পর্যন্ত নিবন্ধনধারীদের আলাদা মেধা তালিকা করা হলো না? যদিও এমনটি কখনো কাম্য নয় কারণ বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে শুধু সনদই ছিল শিক্ষক হওয়ার মাপকাঠি। তাদেরকে নিয়ে সম্মিলিত জাতীয় মেধা তালিকা কেন অযুক্তিক নয় মহামান্য আদালতই ভালো জানেন? তখন শূন্য পদ দেখা হতো উপজেলা ও জেলা ভিত্তিক । ফলে অনেক নিবন্ধনধারী দ্বিতীয়বার চেস্টা করেও মেধাবী হতে পারেনি। কারণ ঐযে বললাম, জেলা বা উপজেলায় বিষয়ভিত্তিক পদ না থাকা। ১-১২ তমরা নিয়োগ বঞ্চিত হয়ে রিট করে অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য। ফলে ১৩ তমদের স্টে হয়। আদালতের নির্দেশে ১-১২ তম, ১৩ তম এবং ১০ তম বিশেষ নিবন্ধনধারীসহ জাতীয় মেধাতালিকা তৈরি করায় সারাদেশে নতুন করে শূন্যপদ পাওয়া যায়। শুধু পরীক্ষা আর পরীক্ষা। মেধাবী নাম করে যাদের সামনে রাখা হয় তাদের নিয়েও রয়েছে প্রচুর বির্তক। ২০১৪-২০১৮ সালে শিক্ষা মন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ-এর বক্তব্য কেউ ভুলে যায়নি। তিনি বলেছিলেন- গুজব ছড়ালে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। উইকিপিডিয়াসহ দৈনিকে এনিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়।
মূল কথায় আসা যাক, তালাশ টিমের রিপোর্ট ও এনটিআরসিএর তথ্য মতে প্রায় ৬০ হাজার জাল সনদধারী আছে যারা দিব্যি হালতে চাকরি করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সনদধারীদের কেন এ বেহাল দশা? উপরোক্ত ২০০৬ সালের ৩০ জুলাই ১-১২ তমদের জন্য যে গেজেট ছিল ১৩ তমদের জন্য ২২ অক্টোবর, ২০১৫ সালের গেজেটে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু মৌখিক বিষয় অতিরিক্ত যোগ করা হয়েছে। ফলে কেউ কেউ ১৩-১৫তমদেরকে বিসিএস পরীক্ষার সাথে তুলনা করছে। তাহলে ২০১৪ সালের ৩৪তম পরীক্ষার পর থেকে তো বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হচ্ছে ১০০ এর পরির্বতে ২০০ তে। এর মানে কি পরবর্তীরা সুযোগ-সুবিধা বেশি পাবে? আমার জানামতে সময়ের প্রেক্ষাপটে কোনো আইন প্রনয়ণ হলে –পূর্ববর্তীদের জন্য তা প্রযোজ্য হবে যদি তা তাদের জন্য ফলপ্রসূ হয়। আর যদি তা সাংঘর্ষিক বা ফলপ্রসূ না হয়, তবে আইনটি শুধুমাত্র সেই সময়কালের পরবর্তীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। ১৩ তমদের একটি অংশ যে গেজেটে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে ব্লক পোস্ট পেল। সেই ধারায় ১-১২তম বা তার পরবর্তীরা কেন পাবে না? তাহলে কি আদালতের দ্বারস্ত না হলে কেউ ন্যায় বিচার পাবে না?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেশরত্ন শেখ হাসিনার ঘোষণা ছিল- আমরা ক্ষতায় গেলে ঘরে ঘরে চাকরি দিবো। তিনি আরও বলেছিলেন – আমরা ক্ষতায় গেলে শিক্ষকদের দাবি আদায়ে রাস্তায় নামতে হবে না। ডিজিটাল ও গুণগত শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে তিনি যোগ্য শিক্ষক দ্বারা বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রকে এগিয়ে নিতে গড়ে তুলেছেন অনলাইন প্লাটফর্ম শিক্ষক বাতায়ন। ২০২১ সালের মধ্যে তিনি ৯ লক্ষ শিক্ষককে শিক্ষক বাতায়নের অন্তর্ভক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা এবং জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের বিকল্প নেই। ১-১২ তমদেমর সনদে যেহেতু লিখা আছে– He/She is eligible to be appointed. শিক্ষক নিবন্ধন সনদ চাকরির সনদ, একাডেমিক সনদ নয়। তাই সনদ যার, চাকরি তার। সুতরাং এনটিআরসিএ’র এ পাহাড় সমান অনিয়ম ও অভিযোগ থেকে মুক্তির পথ একটাই প্যানেল ভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ইনডেক্সধারীদের বদলি নিয়ে ভাবার সময় এখনই। মুজিব বর্ষ হোক অভিশাপ মুক্ত, শোষণ নীপিড়ন থেকে মুক্তি পাক জাতির মেরুদন্ড। জাতির জনকের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে বঞ্চিত শিক্ষকদের প্যানেল ভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে জাতিকে অভিশাপ মুক্ত করা হোক। কেটে যাক কৃত্রিম শিক্ষক সংকট। মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ুক কচিকাঁচার দ্বার প্রান্তে। শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করতে প্যানেল ভিত্তিক নিয়োগ এখন শেখ হাসিনা সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং সময়ের দাবি।
0 মন্তব্যসমূহ