প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্বকে জানান দিয়েছে এক অবিস্মরণীয় বিষ্ময় হিসেবে।এটি জীবনকে করেছে সহজ,বিশ্বকে করেছে আলোড়িত এবং এর ব্যবহার মানুষকে এনে দিয়েছে এক বিষ্ময়কর সাফল্য যা সমাজে এসেছে পরিবর্তনের এক অপরাজেয় বিপ্লব হিসেবে।যার ব্যবহার কতোটা গুরুত্ব বহন করে তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এই করোনাকালে।
কিন্তু এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার সমাজকে এতোটা এগিয়ে নেয়ার পরেও আমাদেরকে বার বার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে এর অপব্যবহারের দিকটি।আর এই অপব্যবহারের প্রধান শিকার হচ্ছে আমাদের শিশু,কিশোর এবং উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা যাদের হাতে আর কিছু থাকুক বা না থাকুক একটা স্মার্ট ফোন দেখা যায়, হোক সেটা বাবা মায়ের নিজেদের কিংবা সেসব বাবা মা কর্তৃক তাদের আদুরে সন্তানকে উপহার দেয়া।
বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাড়িয়েছে ১১ কোটি ৬১ লক্ষ ৪০ হাজার.।অর্থাৎ মোট জনসংখ্যা যদি ১৬৬.৫০ মিলিয়ন(অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০) হয় তাহলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা হয় প্রায় ৭০%।এটি অবশ্যই একটি খুশির সংবাদ।প্রযুক্তির বিকাশে এবং ব্যবহারে যে আমরা অন্যদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছি সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
কিন্তু প্রযুক্তির এতো এতো ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথেই যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এর অপব্যবহার।শিশুদের খাবার এখন আর মুখের ভিতর দিয়ে পেটে যায়না কার্টুন না দেখালে,কিশোর গ্যাং এর দৌরাত্ম্য দিনদিন ভয়ংকর ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে,এসব কিশোর এবং উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা মাদকে আসক্ত হয়ে পরছে।ফেসবুক, মেসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ,ভাইবার, ইমো প্রভৃতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গ্রুপ খুলে কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা বেশ সক্রিয় থাকছে এবং মাদকের চোরাচালান,মাদকের ক্রেতা সংগ্রহ সহ এসব অপরাধমুলক কার্যক্রমগুলোর এক নিরাপদ আবাস হিসেবে এগুলোকে বেছে নিয়েছে।
সম্প্রতি বন্ধুদের দ্বারা এলএসডি মাদকের শিকার আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় অগ্রজ হাফিজ ভাইয়ের নির্মম মৃত্যু আমাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় ভয়াবহ এ মাদকের পরিনতি সম্পর্কে। এখানেও একটা দল “আপনার আব্বা” নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে এই ভয়াবহ এলএসডি মাদকের ক্রেতা সংগ্রহ করতো।আর এই মাদকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ধর্ষণ, চুরি,ছিনতাই, হত্যা সহ অন্যান্য অপরাধগুলো।
গত ৭ জানুয়ারি ঢাকার কলাবাগানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল মাস্টারমাইন্ডের ও লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিন হত্যাকান্ড আমাদের সকলের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিলো। তদন্তে উঠে আসে এক ভয়াল চাঞ্চল্যকর তথ্য আর তা হলো গ্রেফতার ইফতেখার ফারদিন দিহান ইন্টারনেটের মাধ্যমে পর্নগ্রাফী দেখে সেক্স ফ্যান্টাসিতে আসক্ত হয়ে পরে এবং আনুশকার সাথে বিপজ্জনক বিকৃত যৌনাচারে ফরেন বডি বা সেক্স টয় ব্যবহার করে।এগুলো নিশ্চয়ই প্রযুক্তির অপব্যবহার বৈকি ভালো কিছু নয়।
ইদানীং একটা সাধারণ চিত্র পাড়া মহল্লা এবং শহরের রাস্তার আশে পাশে খুব চোখে পরছে আর তা হলো একসাথে অনেকজন একত্র হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল ফোনে গেমস খেলা।কি অদ্ভুত দৃশ্য! কারো সাথে কারো কোন ধরনের কথা নেই,সবাই যার যার মতো করে ফোন স্ক্রোল করছে আর গেমস খেলছে।অসামাজিকতার এক চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে মনে হচ্ছে এটিকে। ।অথচ এই সময়টা ব্যয়ের কথা ছিল নিজেদেরকে গোছাতে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিপাটি করতে নিজেদের যোগ্য রূপে গড়ে তুলতে কিন্তু তা আর হচ্ছে কই! এরই ফলশ্রুতিতে দিনে দিনে বইয়ের সাথে যেমন দুরত্ব বেড়ে চলছে তেমনি ঝুকে পরছে সব অনৈতিক কার্যকলাপের দিকে।এদের ভবিষ্যৎ পরিনতি যে কতোটা ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমেয়।
অথচ এরাই হতে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্ণধার,তাহলে বোঝাই যাচ্ছে আমরা জাতি হিসেবে কাদের হাতে পরবর্তী নেতৃত্ব ছেড়ে দিচ্ছি।
জগতের প্রত্যেকটা আবিষ্কারেরই ভালো এবং মন্দ দুইটা দিক আছে এবং থাকবে।তাই বলে আমরা মন্দের সাথে ভালোর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ভালো দিকটাকে উপেক্ষা করতে পারিনা। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির এমন অপব্যবহার রুখতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অধঃপতন থেকে রক্ষার জন্য আমাদের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়াও দ্বিতীয় কোন উপায় নেই।চাইলেই কোন একক আইন কিংবা কোন গোষ্ঠীর পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে।সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কার সাথে মিশছে,মোবাইল ফোনের দ্বারা কোন অনৈতিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপের সাথে জড়িয়ে পরছে কিনা এসব খোজ খবর রাখতে হবে।আর অপ্রয়োজনে শিশুদের থেকে ডিজিটাল ডিভাইস যতোটা সম্ভব দূরে রাখাই ভালো।অর্থাৎ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহারই যেন সন্তানের দ্বারা সংগঠিত হয় সেটি সবার আগে পরিবারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত প্রযুক্তির অপব্যবহার রুখতে সরকার কর্তৃক একটি আইনের মাধ্যমে বয়স নির্ধারন করে দেয়া যেতে পারে যাতে তারা এই নির্দিষ্ট বয়সের পূর্বে ডিজিটাল ডিভাইস সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে না পারে এবং সেটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ অভিভাবকদেরকেও তাদের সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারির আওতায় আনতে হবে।যাতে কোন শিক্ষার্থী মাদকসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে না পরে এবং এসবে জড়িয়ে পরলে যেন তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হয় সে ব্যবস্থাও গ্রহণ জরতে হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি জোরদার করা যেতে পারতো তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দিনের বেলাতে হাফিজ ভাইয়ের এমন নির্মম পরিনতি হয়ত নাও হতে পারতো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা দিয়েছে এবং এর বাস্তবায়নও আমরা দেখতে পাচ্ছি।এছাড়াও সম্প্রতি শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বিটিআরসি ফ্রী ফায়ার ও পাবজি গেমস বন্ধ করতে যাচ্ছে যা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ এবং আমাদেরকে আশার আলো দেখাচ্ছে। সুতরাং উপর্যুক্ত ব্যবস্থাগুলো গ্রহন করলে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করলে আমরা হয়ত অনেকখানিই প্রযুক্তির এমন ঢালাও অপব্যবহার রুখতে পারবো এবং একটি সুবিবেচক,জ্ঞানী,মাদকমুক্ত,মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও নৈতিকতা বোধসম্পন্ন একটি দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারবো যাদের হাতে নিরাপদ থাকবে এ দেশ ও দেশের মানুষ। আর তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
লিখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইবরাহীম।
0 মন্তব্যসমূহ