আমাদের দিন শুরু হয় সকাল ছয়টায়। ৭টায় ধানমন্ডি থেকে একটি মেয়ের স্কুল বাস ছেড়ে যায়। আমার স্ত্রী তাকে ফেলে দিয়ে ফিরে আসার পর, দ্বিতীয় লটের বাচ্চাদের নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হয় সাতটায়। ফোন করলে শুনলাম, আমার স্ত্রী টিএসসিতে কাজে যাওয়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে না গেলে শাহবাগের মোড়ে গিয়ে শুরু হয় তার অনিশ্চিত অপেক্ষা।
দিনটা ভালই কাটে। কোনো কারণে চালক না থাকলে শিশুদের সঙ্গে রিকশায় করে আসতে হয়। সেদিন রাজপথের গাড়িগুলো যেন দানবীয়। এই দানবদের গর্জনে রিকশা কোনও রকমে গর্জনে রাশ টানার চেষ্টা করে। আমি আমার কোলে একটি শিশুকে ধরে রেখেছি, আমার পাশে একটি শিশু এবং আমি উদ্বিগ্ন। রিকশায় ধারালো মোচড় দিয়ে বাচ্চা ছিটকে পড়লে, রাস্তায় ধাক্কা লাগলে মাঝে মাঝে কোথাও দেরি হয়ে যায়- খারাপ বুকে এ ভাবে দিন কাটাতে হয়।
এই শহরে কোন রাস্তা নেই, কোন সড়ক ব্যবস্থাপনা বা সড়ক প্রশাসন নেই। এই শহরে জাতির প্রভু, উন্নয়নের প্রভু, পুলিশের প্রভু, বিচারের প্রভু। তাঁদের অমাবসরণ, নবরত্ন, রক্ষী রয়েছে। তাদের ঔদ্ধত্য ও অবিচার আছে, বাকি মানুষের জন্য। শুধু কষ্ট বোঝার ইচ্ছা বা বাধ্যবাধকতা নয়।
কিন্তু আমরা ভাগ্যবান। আমি এই শহরে একটি সাধারণ গাড়ী কিনেছি। গাড়ি না পেলে অনেক ভয়ে দিন কাটাই। আমার মনে হয়, যাদের প্রতিদিন রিকশায় করে চলাফেরা করতে হয়, তারা প্রতিদিন কত অসীম দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তা আমার জানা নেই। আমার মনে হয়, ফুটপাত না পেয়ে রাস্তায় হেঁটে আসা শিশুটি স্কুলে যায়, তার কী বিপজ্জনক জীবন আছে, তার বাবা-মা।
দুই দিন আগে মিরপুর এলাকায় রিকশায় করে সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় মহাসড়কে প্রাণ হারান এক মা। গত বছর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রাণ হারান তাঁর স্কুলেরই এক মা ও এক শিশু। আর কত ঘটনা, তা কল্পনা করা যায়, প্রতি বছর রাজধানী শহরের স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে ৪০ থেকে ৫০ জন শিশু বা তাদের বাবা-মা মারা যায়। একটি দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে কয়েকশ শিশু-কিশোরের মৃত্যু হয়!
আর আমরা যারা বেঁচে থাকি বা বেঁচে থাকি, তারা কমবেশি প্রতিদিন অমানবিক কষ্টে দিন কাটাই। বায়ুদূষণে সবচেয়ে খারাপ, শব্দদূষণের সবচেয়ে কুৎসিত, রাস্তায় অসহনীয় যানজটের জেরে প্রতিদিনই স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় শহরকে।
0 মন্তব্যসমূহ