নির্বাচনে কোন একটি দলের পরাজয়ের পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। তবে তারমধ্যেও দুই একটি কারণ থাকে, যা উল্লেখযোগ্য।
কোন দলকে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকতে হলে, ওই দলের নির্বাচনী ইশতেহারে ভোটারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি থাকতে হয়। ইশতেহার দেখে যদি কোন বিশেষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বা লিঙ্গের ভোটারদের কাছে মনে হয় যে তাদের সাথে বৈষম্য করা হচ্ছে, তবে তারা আর ঐ দলকে ভোট দেয় না। অনেক ক্ষেত্রে মন্দের ভালো হিসেবে বিকল্প দলকেও ভোট দেয় তাঁরা।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসেবে দলটির লিঙ্গবৈষম্যমূলক ইশতেহারকে দায়ী করেছেন স্বয়ং বিজেপিরই এক নেতা, উত্তরণ পাঠক। গত একমাস পূর্বে দলটির “বিতর্কিত ও নারীতোষণমূলক ইশতেহার” পরিবর্তন করার দাবী জানিয়ে রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একটি আবেদনপত্র দাখিল করেছিলেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনা পর্যালোচনা হয়, এবং এক পর্যায়ে এই নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল বাকবিতন্ডা হয় বলেও জানান তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত আর পরিবর্তন করা হয়নি দলটির সেই “নারীতোষণমূলক ইশতেহার”।
গতকাল উত্তরণ পাঠক তাঁর ভেরিফাইড পেইজে এই সম্পর্কে একটি লিখিত বক্তব্য প্রকাশ করেন। বক্তব্যটি হুবহু আপনাদের সামনে তুলে ধরা হল।
“শেষপর্যন্ত আমার আশঙ্কাই সত্যি হলো।
আমি আজ থেকে একমাস আগেই এই আশঙ্কা করেছিলাম। কারণ যে পরিমাণে নারীতোষণের কথা বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিল তা সাধারণ কোন মানুষ ভালোভাবে মেনে নেবে না। বিশেষ করে পুরুষেরা তো নয়ই। এই বিষয়ে সবার আগে বিজেপির পার্টি অফিসের ভেতরে বিজেপি মহিলা মোর্চার সদস্যদের সামনেই এই নিয়ে আমি তীব্র বাদানুবাদ করেছিলাম।
রাজ্য বিজেপির প্রধান দপ্তরে এর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র আমি জমা দিয়ে এসেছিলাম এবং সেখানে লিখেছিলাম যে নির্বাচনী ইশতেহারের এই নারীতোষণের বিষয়টি বিজেপির বিরুদ্ধে কিন্তু ভয়ানক রকম বুমেরাং হতে পারে কারণ এই বাংলায় তৃণমূল সরকারের কন্যাশ্রী এবং রূপশ্রী নিয়ে বহু পুরুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। গত চার-পাঁচ বছর ধারাবাহিকভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীর তুলনায় ছাত্র সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বহু ছেলের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়ে তারা হয় কারখানায় শ্রমিকের কাজ নিয়েছে অথবা বিভিন্ন অসামাজিক কাজে তারা জড়িয়ে পড়েছে শুধুমাত্র এই বর্তমান সরকারের নারীতোষণ নীতির কারনে।
অতীতেও বিজেপিকে ঠিক এই নারীতোষণ নীতি নির্বাচনী ইশতেহারে আনার জন্যই কিন্তু দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ফলভোগ করে নাকে ঘসা খেতে হয়েছিল যখন বিজেপির তরফ থেকে বিষাক্ত নারীবাদী কিরণ বেদীকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় অতীত এবং বর্তমানের এই সমস্ত বিষয়গুলি পর্যালোচনা করেও বিজেপি কিন্তু তার শিক্ষা গ্রহণ করেনি।
উল্টে এই বিধানসভা নির্বাচনেও নারীদের জন্য একগুচ্ছ ভুতুড়ে প্রকল্প ঘোষণা করে বিজেপি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনল।
আরেকবার তাহলে পর্যালোচনা করা যাক নারী উন্নয়নের নাম করে বিজেপি ঠিক কি কি লিঙ্গবৈষম্যমূলক প্রকল্প ঘোষণা করেছিল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে।
১. যে কোন চাকরিতে 33% মহিলা সংরক্ষণ।
২. নার্সারি থেকে উচ্চশিক্ষা অবধি নারীদের পড়াশোনার খরচ পুরোপুরি ফ্রি।
৩. সরকারি পরিবহন ব্যবস্থায় মহিলাদের যাতায়াত পুরোপুরি ফ্রি।
৪. আঠারো বছর বয়স হলে প্রত্যেকটি মেয়ে ২ লক্ষ করে টাকা পাবে।
প্রথম বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। যেকোনো চাকরি যদি কখনো একটি বিশেষ লিঙ্গের অধিকারী হওয়ার জন্য থাকে তা সমাজের পক্ষে কখোনই সুস্থতা অবলম্বন করেনা। ভেবে দেখুন তো আপনারা এমনিতেই তো চাকরিতে তফসিলি জাতি, তফসিলি উপজাতি এবং আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণ রয়েছে সাথে সংরক্ষণ রয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যেও আর এগুলি দেশের সংবিধান আর সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী থাকতেই হবে । সাধারণদের জন্য যা বরাদ্দ রয়েছে তা খুবই কম তার মধ্যে যদি ৩৩% মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যায় তাহলে বহু পুরুষ নিজের যোগ্যতা থাকা সত্বেও সে শুধুমাত্র পুংলিংগের কারনে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পাবেনা।
এবার আসছে দ্বিতীয় বিষয়ে। এখানে বলা হয়েছিল যে নার্সারি থেকে উচ্চশিক্ষা অবধি মহিলাদের পড়াশোনা সম্পূর্ণ ফ্রি। এবার আপনারা বলুন তো ভোট কি শুধুমাত্র নারীরাই দেয়? আমরা পুরুষরা কি আমাদের নিজেদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করি না? যদি বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় আসতো তাহলে বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতো কি শুধুমাত্র মহিলারা? আমরা পুরুষরা কি ভোট দিতাম না বিজেপিকে? একবারও কি এক্ষেত্রে ভেবে দেখা যেত না যে কত গরিব ঘরের ছেলের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র একটিই কারনে যে তারা পুরুষ হয়ে জন্মেছে। আর যেহেতু তারা পুরুষ হয়ে জন্মেছে তাদের জন্য কোন সরকারি প্রকল্প নেই তাদের জন্য কারোর কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই। তাদের কাজ কি শুধুই রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতায় আনা? আর রাজনৈতিক দলগুলির হয়ে মিটিং মিছিল করে প্রচার করা আর বিরোধী পক্ষ অথবা শাসকদলের হাতে মার খেয়ে হয় ভয়ানকরকমভাবে আহত অথবা নিহত হওয়া কারণ যে কোন রাজনৈতিক হানাহানিতে যারা আহত এবং নিহত হয় তারা কিন্তু সকলেই পুরুষ।
তৃতীয় বিষয়ে এলাম। সরকারি পরিবহন ব্যবস্থায় মহিলাদের জন্য যাতায়াত সম্পূর্ণ ফ্রি। আচ্ছা আপনারাই বলুন তো একটি চাকুরিরতা মেয়ে যে মাসে 30 হাজার টাকার উপরে বেতন পায় সে বিনামূল্যে সরকারি পরিবহন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে অথচ একটি বেকার ছেলে যে চাকরি খুঁজছে এবং তার কোনো মাসিক রোজগার নেই তাকে পয়সা দিয়ে সরকারি পরিবহনে যাতায়াত করতে হবে। কেন বলুনতো? পুরুষরা কি সব বানের জলে ভেসে এসেছে? নাকি আমরা পুরুষেরা কেউ মানুষ নই? উত্তর দিতে হবে এখন রাজ্য বিজেপিকে।
চতুর্থ অর্থাৎ সর্বশেষ বিষয়ে বলা হয়েছিল যে ১৮ বছর বয়স হলেই সমস্ত মেয়েদের দু লক্ষ টাকা করে প্রদান করা হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একজন ডাক্তার অথবা শিল্পপতির মেয়েও যখন তার ১৮ বছর বয়স হবে তখন তার ব্যাংকে দু লক্ষ টাকা ঢুকবে অথচ একজন রিক্সাওয়ালার ছেলে যখন ১৮ বছর বয়স হবে তখন তার বাবা যদি কোনোরকমভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তাহলেও
তাকে রিক্সার প্যাডেলেই পা দিতে হবে কারন সে লিঙ্গে পুরুষ। তার জন্য নেই কোনো সরকারী প্রকল্প নেই কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা।
বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা এবং রাজ্য বিজেপির নেতারা অতীতে বিভিন্নরকম ঘটনা দেখেও কিন্তু শিক্ষা নেন নি। আজকে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অবশ্যই বিজেপিকে খুবই দরকার ছিল কারণ আজকে আমরা পশ্চিমবঙ্গের জনগণ খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে রয়েছি। এর থেকে উদ্ধার একমাত্র হতে পারতো যদি বিজেপি এখানে ক্ষমতায় আসতো এবং বিজেপির সেই সুযোগও ছিল কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারল না বিজেপি। আজকে কেন্দ্র এবং রাজ্যে যদি একই সরকার ক্ষমতায় থাকতো তাহলে আর কিছু না হোক উন্নয়ন হত এই পশ্চিমবঙ্গের। ভেবে দেখুন তো ৩৪ বছর ধরে যখন বামফ্রন্ট রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল কেন্দ্রে কি কোনো বন্ধু সরকার ছিল? উত্তর হলো-না। যখন গত ১০ বছর ধরে রাজ্যে তৃণমূল সরকার তখনো কেন্দ্রে বিরোধী সরকার।
ভাবুনতো ১৯৭০ সালের আগে অবধি যখন রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল তখন কেন্দ্রে কিন্তু কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল আর সেই সময় রাজ্যের উন্নয়ন কিন্তু বেশ ভালোরকমই এগিয়ে ছিল। একাধিক কল কারখানা স্থাপিত হয়েছিল সেইসময়। এবং এটাই কিন্তু দরকার। কারণ যে কোন রাজ্যের উন্নয়নমূলক প্রকল্পে যে টাকা খরচ হয় তা কিন্তু কেন্দ্র থেকেই Sanction হয়। ভেবে দেখুন আমার আর্থিক প্রয়োজনে আমি কিন্তু কখনোই কোনো বাইরের লোকের কাছে টাকা চাইতে পারিনা এবং যদি আমি টাকা চেয়েও থাকি যে পরিমাণ টাকা আমি পাবো সেই একই কারনে আমি যদি আমার প্রয়োজনে নিজের বাবা অথবা মায়ের কাছে যদি টাকা চাই তাহলে তার পরিমাণ অনেক বেশি হবে এবং এটাই স্বাভাবিক।
অর্থাৎ কেন্দ্র এবং রাজ্যে যদি একই সরকার থাকে তাহলে বোঝাপড়াটা ভালো রকম হয় এবং তা যে কোন রাজ্যের পক্ষে ভালো বই খারাপ কখোনই হয়না।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দুজনেই সেই সুযোগটা হারালো যা আমাদের রাজ্যের পক্ষে কখনই সুখকর হলনা।
পরিশেষে একটাই কথা বলে যাচ্ছি পুরুষকে বঞ্চিত করে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের রাজনৈতিক জমি তৈরি করতে পারবে না। যারাই সেটা করতে যাবে তাদেরকেই তার ফল ভোগ করতে হবে এবং বর্তমানে সেটাই হয়ে চলেছে।
বিধানসভা ভোটের ফলাফলে বিজেপির ভরাডুবি তারই উদাহরণ এবং এই ফলাফলের পর্যালোচনা অবশ্যই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে করতে হবে।”
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ