অথচ দুইজনের অপরাধের মধ্যে তুলনা করলে ফারহানা ইয়াসমিনের অপরাধটি বড় অপরাধ। কারণ সে একজন নারী হয়েও পারমিশন ছাড়া ছেলেদের গায়ে হাত দিয়েছে। বিপরীত লিঙ্গের কারো গায়ে হাত দেওয়াটা বড় অপরাধ, সমলিঙ্গের কারো গায়ে হাত দেওয়ার তুলনায়।
গাইনোসেন্ট্রিক (gynocentric) সমাজব্যবস্থায় যে নারী সংবেদনশীলতা থাকবে, এবং এই সংবেদনশীলতাকে ব্যবহার করে অক্যাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে এটা তো বাস্তব সত্য। কিন্তু এই সত্যটা বলা যাবে না, দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে হবে, পাছে আবার নারীতন্ত্রের পাছার কাপড় খুলে যায়। খিক খিক….
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদেরকে চুল কেটে দিয়ে লাঞ্ছিত করা সেই ‘শিক্ষিকা’ ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন সাহেবকে সেদিন দেখলাম একাত্তর টিভির টকশোতে গিয়ে হাসতে হাসতে বলছেন, এটা কি মগের মুল্লুক নাকি যে আমাকে বহিষ্কার করবে? নারী সংবেদনশীল সমাজের প্রতি ঠিক কতটা আস্থা থাকলে একজন নারী অপরাধী এতটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে যে, তাকে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা চাকরি থেকে বহিষ্কার ও সম্ভব না?
এরকম ঘৃণ্য একটি অপরাধ করেও সে টকশোতে এসে কথা বলার মত সুযোগ পায় কী করে! তার তো এখানে বসে টকশো করার কথা ছিল না, এতক্ষণে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়ার কথা ছিল। শিক্ষিকা ছাত্রের চুল কেটে না দিয়ে যদি কোন শিক্ষক ছাত্রীর চুল কেটে দিত, তাহলে নিঃসন্দেহে সেই শিক্ষক এখন জেলে থাকত।
অনেকে হয়তো ভাবছেন যে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থাকায় ওই মহিলাকে গ্রেফতার করা সহজ নয়। এটা ভেবে থাকলে আপনি আসলে ভুল ভাবছেন। কারণ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রায় সপ্তাহ খানিক পরে, একই অপরাধে লক্ষীপুরের রায়পুরে একজন শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট থানার (রায়পুর) ওসি আব্দুল জলিল উক্ত শিক্ষককে গ্রেফতার করার কারণ সম্পর্কিত বিবৃতিতেও বলেছেন যে কারো চুল কেটে দেওয়াটা ফৌজদারি অপরাধ। তাহলে একই অপরাধে ফারহানা ইয়াসমিন গ্রেফতার হল না কেন?
অথচ দুইজনের অপরাধের মধ্যে তুলনা করলে ফারহানা ইয়াসমিনের অপরাধটি বড় অপরাধ। কারণ সে একজন নারী হয়েও পারমিশন ছাড়া ছেলেদের গায়ে হাত দিয়েছে। বিপরীত লিঙ্গের কারো গায়ে হাত দেওয়াটা বড় অপরাধ, সমলিঙ্গের কারো গায়ে হাত দেওয়ার তুলনায়।
লক্ষীপুরের উক্ত শিক্ষককে গ্রেফতারের জন্য শিক্ষার্থীদেরকে কোন আন্দোলন করতে হয়নি, কোন অনশন কর্মসূচি দিতে হয়নি। অন্যদিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী অপমান সইতে না পেরে ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। নিপীড়নকারী শিক্ষিকার বিচারের দাবীতে রবি শিক্ষার্থীদেরকে বিক্ষোভ মিছিল করতে হয়েছে, এমনকি আমরণ অনশন কর্মসূচি পর্যন্ত দিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসননের কি দায়িত্ব ছিল না অপরাধী শিক্ষিকাকে ফৌজদারি আইনে বিচারের মুখোমুখি করা? সেটা না করে (সাময়িক) পদত্যাগের একটা নাটক মঞ্চস্থ করা হল। উল্টো ছাত্র আন্দোলনকেই দমন করার চেষ্টা করা হল। একটা নিপীড়ককে আশ্রয় প্রশ্রয় দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ করে দেওয়া হল।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ভিসি আব্দুল লতিফ “শিক্ষিকা কর্তৃক ছাত্র নিপীড়ন” এর ঘটনাটি স্বীকারপূর্বক বলেছেন যে নিপীড়ক শিক্ষিকাকে পানিশমেন্ট দেওয়াটা তার এখতিয়ারের বাইরে! নিপীড়ককে দ্রুত গ্রেফতারের জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়াটাও কি বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ারের বাইরে? অথচ জাবিতে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভাঙচুরের অভিযোগ এনে ৪২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে! যেখানে বিনা অপরাধেও মামলা দায়ের করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সেখানে একটা চিহ্নিত নিপীড়ককে এভাবে ছাড় দেয়া কেন?
উক্ত টকশোতে বাতেন সাহেব তার লিঙ্গের কথা সবাইকে আরেক দফা স্বরণ করিয়ে দিতে বলেছেন যে “দেখেন আমি কিন্তু একজন নারী চেয়ারম্যান!” আচ্ছা ভাবুন তো, তিনি তার পেশাগত পরিচয়, এবং প্রশাসনিক পরিচয়কে ছাপিয়েও তার লিঙ্গকে কেন সামনে আনলেন? কারণ এই লিঙ্গের মধ্যেই নিহিত আছে বাতেন সাহেবের বাতেনি কারামত!
এই কারামত নতুন নয়। দুই কোটি টাকা চুরির দায়ে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফারজানা ইসলামকে অপসারণের দাবিতে যখন ছাত্র-ছাত্রীরা তার কুশপুত্তলিকা দাহ করল, তখন সেটিকে নারীর প্রতি সহিংসতা আখ্যা দিয়ে পাল্টা কর্মসূচি দিল নারীবাদী শিক্ষিকারা। জাবি ছাত্রছাত্রীদেরকে বলা হল নারীবিদ্বেষী। ফারজানা ইসলাম বললেন, আমি নারী ভিসি বলেই আমাকে সরানোর চেষ্টা হচ্ছে। ব্যাস। এত বড় একটা দুর্নীতির ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গেল। দুর্নীতির তদন্ত তো দুরের কথা, তদন্ত কমিটিটা পর্যন্তও গঠন করা হল না। অথচ সমসাময়িক সময়ে এই দুর্নীতির অভিযোগে গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ঠিকই পদত্যাগ করতে হয়েছে।
আমাদের দেশে তো আবার, অপরাধী গ্রেফতার হওয়ার পরে জেন্ডার বিবেচনায় জামিন নিয়ে বের হয়ে আসার নজিরও আছে। একজন আসামীর শুধুমাত্র নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের মাধ্যমেই মুক্তি পাওয়ার সুযোগ থাকা উচিত, কোনপ্রকার জেন্ডার আইডেন্টিটিকে ব্যাবহার করে নয়।
একজন অপরাধী যদি নিশ্চিত থাকে যে, সে যতই অপরাধ করুক না কেন, তার লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে সমাজ তাকে কোন না কোনভাবে পার পাইয়ে দেবে, তবে সে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করবে কেন?
লেখক : খালিদ এম তন্ময়
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
.
0 মন্তব্যসমূহ